বাঁধাকপি চাষ পদ্ধতিঃ
রবি মৌসুমের একটি প্রধান সবজি। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বাঁধাকপির চাষ হয়। বাঁধাকপি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। এদেশে উৎপাদিত বাঁধাকপির প্রায় সব জাতই বিদেশী ও হাইব্রিড। সব জাতের বীজ এদেশে উৎপাদন করা যায়না। তবে এদেশে বীজ উৎপাদন করা যায় বারি উদ্ভাবিত এমন জাতও আছে।
বাঁধাকপির চাষ, একই গাছে অনেক ফল ফলানোর পদ্ধতি আমরা সাধারণত মৌসুমে একটি গাছে একটি বাঁধাকপির ফলনই দেখে আসছি কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় একই মৌসুমে একই গাছে চারটি বাঁধাকপি ফলানো সম্ভব, তবে বিষয়টি আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। আর এই অসম্ভবই সম্ভব করেছেন এদেশের একজন প্রগতিশীল কৃষক রেজিন কোড়াইয়া। ভদ্রলোক মূলক একজন অর্থনীতিবিদ, কিন্তু এখন কালিগঞ্জে নিজ গ্রামে কৃষিকাজে ব্যস্ত। তিনি তাঁর মাঠে কাজ করতে করতেই বাঁধাকপির অস্বাভাবিক ফলনের এই উদ্ভাবনটি ঘটিয়েছেন। একদিন বাঁধাকপির মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহের সময় এই ঘটনাটি ঘটে। কপিটি কাণ্ড থেকে কাটার সময় কপির নিচের দিককার তিনটি পাতা অসতর্কভাবেই কাণ্ডের সাথে থেকে যায়। দু-চার দিন পর মাঠের অন্য পরিপক্ক কপিগুলো কাটতে এলে আগের পাতাযুক্ত কান্ডের দিকে তাঁর দৃষ্টি যায়। খুব খেয়াল করে দেখলেন প্রতিটি পাতার সংযোগস্থলে নতুন কুঁড়ি জন্মেছে। উদ্ভাবনী চেতনা তাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তিনি ভাবলেন নতুন করে এই কাণ্ডের যদি যত্ন নেয়া যায়, তবে হয়তো এই কুঁড়িগুলো বড় হয়ে বাঁধাকপি হিসাবে ফলবে।
পুষ্টি মূল্যঃ
বাঁধাকপি একটি অন্যতম পুষ্টিকর পাতা জাতীয় সবজি। এত প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন‘এ‘ রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি বেশ উপকারী।
মাটিঃ
অত্যধিক বেলে মাটি ছাড়া যে কোন ধরনের মাটিতে এটি জন্মে। বেলে দোঁআশ থেকে পলি দোঁআশ মাটি এ ফসলের জন্য উপযোগী।
জাতঃ
আগাম জাত লাগাতে চাইলে লাগাতে হবে কে কে ক্রস এবং এক্সপ্রেস ক্রস জাত দুটি। মধ্যম সময়ের উপযোগী জাত হল কে ওয়াই ক্রয়, এটলাস ৭০, টোকিও প্রাইড, গ্রীন এক্সপ্রেস, প্রভাতী ইত্যাদি। আর দেরীতে লাগাতে চাইলে লাগাতে হবে এটলাস ৭০,লিও ৮০, সেভয়, রুবি বল, ড্রাম হেড ইত্যাদি। এ দেশের আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে চইলে করতে হবে বারি বাঁধাকপি ২ (অগ্রদূত), ইপসা বাঁধাকপি ১। সমপ্রতিক আমদানীকৃত হাইব্রিড জাতসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সামার ওয়ারিয়র এফ ১,লরেন্স এফ ১, গ্রীন ৬২১ এফ ১, সামার ষ্টার এফ ১, গ্রীন কর্নেট এফ ১, অটাম কুইন এফ ১, সুপার ট্রপিক এফ ১, সামার বয় এফ ১, গ্রীন বল ৪০ এফ ১, সুপ্রিম কুইন এফ ১ ইত্যাদি।
লাগানোর সময়ঃ
লাগানোর সময় বাঁধাকপি শীতকালেই ভাল হয়। শীত মৌসুমে আগাম ও নাবী করেও চাষ করা যায়। তবে সমপ্রতি গ্রীষ্ম ও বর্ষকালেও বাঁধাকপি উৎপাদিত হচ্ছে। মৌসুমভেদে বাঁধাকপির বীজ বপনের সময় নিচে দেয়া হল-
বীজ বপনের সময় চারা রোপণের সময়
- আগাম শ্রাবণ-ভাদ্র, ভাদ্র-আশ্বিন
- মধ্যম আশ্বিন-কার্তিক কার্তিক-আগ্রহায়ণ
- নাবি অগ্রহায়ণ-মধ্য পৌষ পৌষ-মধ্য মাঘ
বীজের পরিমাণঃ
জাত ভেদে প্রতি শতকে ২-৩ গ্রাম, হেক্টর প্রতি ৫০০-৭০০ গ্রাম।
চারা উৎপাদন পদ্ধতিঃ
বাঁধা কপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। বীজতলার আকার ১ মিটার পাশে ও লম্বায় ৩ মিটার হওয়া উচিত। সমপরিমাণ বালি, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরাঝুরা করে বীজতলা তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা রোপণের আগে ৭/৮ দিন পূর্বে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমত না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়া ভাল।
জমি তৈরি ও চারা রোপণঃ
গভীর ভাবে ৪-৫টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর বা ৫/৬টি পাতা বিশিষ্ট ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা চারা সাধারণতঃ বিকেল বেলা জমিতে রোপণ করতে হয়। তবে সুস’ ও সবল হলে চারা এক-দেড় মাস বয়সের চারা রোপণ করা যায়। রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দুরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪৫ সেন্টিমিটার দিলে ভাল হয়। এ হিসেবে প্রতি শতকে ১৫০টির মত চারার প্রয়োজন হয়। আঙ্গিনায় ৫ মিটার লম্বা একটা বেডের জন্য ২০-২২টি চারার প্রয়োজন হয়। বেডে দুই সারিতে চারাগুলো লাগাতে হবে। আঙ্গিনায় লাগানোর জন্য যেহেতু কম চারার দরকার হয় সেজন্য কোন বিশ্বস- নার্সারি থেকে চারা কিনে লাগানো ভাল। তবে একটা বেডে বাঁধাকপির চারা তৈরি করে অল্পদিনের মধ্যেই তা বিক্রি করে যেমন অধিক লাভবান হওয়া যায় তেমনি নিজের প্রয়োজনও মেটানো যায়। এত ভাল চারা পাওয়াটা নিশ্চিত হয়।
সার প্রয়োগ ও সেচ দেয়াঃ
প্রতি শতকে গোবর ১২৫ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ৮০০ গ্রাম, এমওপি ৬৫০ গ্রাম সার দিতে হবে। সম্পূর্র্ণ গোবর ও টিএসপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার ২ কিসি-তে চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর একবার এবং ৩০-৪০ দিন পর আর একবার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার পর পরই সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া ২-৩ দিন পর পরই সেচ দিতে হবে। গাছ বড় হবার সাথে সাথে দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি তুলে সারি বরাবর আইলের মত করে দিতে হবে। ফলে দু’সারির মাঝে নালা তৈরি হবে। এতে সেচ দিতে বেশ সুবিধে হবে।
পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনাঃ
এদেশে বাঁধাকপির সবচে ক্ষতিকর পোকা হল মাথা খেকো লেদা পোকা। নাবী করে লাগালে সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ বেশি ক্ষতি করে। বীজ উৎপাদনের জন্য চাষ করলে পুষ্পমঞ্জরীকে জাব পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যান্য পোকার মধ্যে ক্রসোডলমিয়া লেদা পোকা, বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি মাঝে মাঝে ক্ষতি করে থাকে।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
বাঁধাকপির পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ প্রধান সমস্যা। এছাড়া চারা ধ্বসা বা ড্যাম্পিং অফ, মাথা পচা বা গ্রে মোল্ড, ক্লাব রুট বা গদাই মূল, মোজেইক, পাতার আগা পোড়া ইত্যাদি রোগও হয়ে থাকে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলনঃ
চারা রোপণের ৬০-৯০ দিন পর বাঁধাকপি সংগ্রহ করা যায়। প্রতিটি বাঁধাকপি গড়ে ২.৫ কেজি হয়। ফলন এক শতকে ১৫০-১৮০ কেজি, হেক্টরে ৭৫-৮০ টন, প্রভাতী জাতের ফলন ১১০-১১০ টন/হেক্টর।
Login to ask a question